Monday, August 30, 2010

MUKHO MUKHI -- Bengali short story

                   মুখোমুখি

                          ------সূর্যশুভ বন্দ্যোপাধ্যায়

 

   দো'তলার বারান্দায় আরাম কেদারায় একা বসেছিল। সধ্যা অনেকক্ষণ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। রাত্রি শাসনের জন্যে চাঁদও মধ্যমণি হয়ে বসেছে অনেকক্ষণ। ঝোড়ো হাওয়া বইছে... তা প্রায় আজ সারাদিন। প্রায় অন্ধকারবারান্দার বাতিটা আর জ্বালাতে ইচ্ছে হল না আজ, জ্বালাইও না এই সময়। বারান্দার এককোণায় ঝুম মেরে বসে থাকা আকৃতিটা বোঝা যায় মাত্র। চুপচাপ পাশটাতে গিয়ে বসলাম। যেমন বসে এসেছি এতকাল... সত্যকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে...বাস্তব কে এক ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে...রোজ এখানে এসে বসি আর আমার পাশে বসে ঝুম মারা একটা ছায়া...

আমি বললাম

"আজ একটা কথাও বলব না"

আমার মাথায় হাত রাখল সস্নেহে—"রাগ করেছিস?"

"বয়ে গেছে"

"তা বেশ...তা হ্যাঁ রে, দু'গাল বেয়ে তবে কী পড়ছে?..."

"তোমার জানার কী দরকার? কেন আস রোজ রোজ?"

"তুই কেন এসে বসিস রোজ?"

"জানি না..."

"ঠিক?"

"বসি বেশ করি...তোমার কি? আমার ইচ্ছে আমি বসি..."

"আমারও তো তেমন ইচ্ছে...তোকে দেখতে ইচ্ছে করা না?"

"একটাও বাজে কথা বলবে না...মিথ্যেবাদী...শুধু বুজরুকী..." গলা বুজে আসে আমার। কথা গুলো দলা পাকিয়ে যায়...হঠাত আগল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চায় হুড়মুড় করে কান্নার শব্দে... "কেন? কেন? কী আনন্দ পাও রোজ?"

 

হাঁপ ধরে যায়। এ সময়টা আমার কাছে বড্ড প্রিয়। দুঃখ যেমন সবার কাছে সবথেকে মূল্যবানবিচ্ছেদ-বেদনা-হতাশা...এসব না থাকলে কী রোজ রোজ এই সময়টা আসত? বড্ড যন্ত্রণা হয় বটে...তবুও চাতকের মত চেয়ে থাকি এই সময় খণ্ডটার জন্য। দিনের শেষে এই এক ফালি বারান্দাই চাঁদ এসে বসে। আর ওই আলোর পথে ধরে ও এসে বসে ওই আরাম-কেদারাটায়। যেমন আগে এসে বসত...রোজ...আমার সাথে দু'চার কথা বলে আর খালি কাঁদায় আর তারপরে চলে যায়। আমিও ফিরে আসি ...তবু কিসের যে এক আমোঘ টান।

 

হাত দিয়ে চোখ মুখ ঢেকে বসেছিলাম। আলতো ভাবে আমার মাথায় আবার হাতটা রাখল

"এ বাবা...বড় হচ্ছিস না? এখনও কেউ কাঁদে? আয় আমার কাছে আয়।"

চাঁদের আলোয় ওই ঝুম মারা আকৃতির মধ্যে একটা স্মিত হাস্য ফুটে ওঠে।

"হাসছ? লজ্জা করে না তোমার?" কর্কশ হতে চেষ্টা করি।

"ওই দেখ...এদিকে আয়...ওই দেখ কাঁঠাল গাছটায় একটা ঘুড়ি আটকে গেছে"

"চুপ কর বলছি"

"সেবার মনে আছে? রণির সাথে বাজি লড়েছিলাম?"

"কী চাও তুমি?..." বাঁধ যেন শিথিল হয়ে আসে ক্রমশ।

"ভোকাট্টা...তেতলায় ছাতে যাবি ঘুড়ি ওড়াতে?"

"আমি আর পারছি না"

"চিলেকোঠায় লাটাইটা এখনও আছে? না থাকলে কিনতে হবে...রত্নার দোকানে মাঞ্জা পাওয়া যায় না?...এখন কত দাম রে?"

"শেষ বারের মত বলছি...তুমি চুপ কর"

"রণিকে ভোকাট্টা করবই এবার...যাবি?...কীরে? চুপ করে আছিস কেন? তোর হয়েছেটা কী? ঘুড়ি ওড়াসনা আর?"

"তুমি জান না?" আর জল না...যেন এবার আগুন জ্বলছে আমার মাথায়...

ও কেবল হাসছে... "কী চাও?" হাসি "হাসছ কেন?"...হাসি...খুব জোড়ে ঝাঁকাতে লাগলাম... "বল, আজ বলতেই হবে...কী চাও বল..." কেমন যেন বিবশ হয়ে যাচ্ছে আমার চারিপাশআমার চিতকার যেন গুটিয়ে যাচ্ছে একটা বর্মের মধ্যে আর সেই চিতকার কে ছিন্নভিন্ন করে চারিদিক কাঁপিয়ে সেই অট্টহাস্য... "চুউউউউপ"...গোটা বহ্মাণ্ড যেন পলকে নিথর।

 

আমি জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছি...দুর্বল লাগছে খুব...শরীরে আর তাকত নেই...ইচ্ছে হচ্ছে সব তছনছ করে দিতে। কিন্তু চারিদিকে তো কিছুই নেই, আমি যেন মহাশূন্যে ভাসছি। কোথায় বারান্দা, চাঁদ...ওই ঝুম মারা আকৃতি... "কী চাও? আমাকে বাঁচাও...আমি মা'র কাছে যাব..." সে শব্দ যেন কেউ শুনতে পাচ্ছে না।

 

"তোর সবুজ জামাটা বেশ"

আমার উত্তর দেওয়ার শক্তি নেই...ভ্যাবলার মত তাকিয়ে রইলাম।

"কটা হল এবার পূজোয়? শেষবার মনে আছে?"

"মনে করতে চাই না...তুমি এবার যাও"

"তাড়িয়ে দিচ্ছিস?"

"আমাকে কষ্ট দাও কেন?

"অভিমান হয়েছে?"

"আমাকে কাঁদিয়ে কী আনন্দ পাও?"

"আমার প্রিয় রঙ কী ছিল বলত?"

"বলব না"

"শেষবার সবুজ জামা তোকে আর তোর প্রিয় নীল আমাকে দিয়েছিল দিদুন, মনে আছে?"

"আমি আজ আর পারছিনা"

"দিদুন কেমন আছে রে?"

"দয়া করে যাও..."

"কতদিন দেখিনি রে...মা-বাবা?"

"তুমি যাও বলছি...যাও...আমাকে আর কাঁদাবে না...খবরদার বলছি..."

"তোর সামনে পরীক্ষা না? এদিকে তো কাল বললি কোন বন্ধুর সাথে আবার ঝামেলা বাঁধিয়েছিস..."

"বেশ করেছি...তোমাকে যেতে বলেছি তুমি যাও"

"প্রিপারেশন কেমন? মনে আছে তোর পড়া ধরতাম, মা সামনে না থাকলে?"

"তার মানে তুমি এখন যাবে না?...তাহলে একটা কথা স্পষ্টই শোন...আজ অব্দি যত খারাপ কিছু হয়েছে তার কারন জেনেছি...খারাপ রেজাল্ট, বিচ্ছেদ, ঝগরাসব কিছুর একটা কারণ ছিল, বুঝেছি কেন...শুধু বুঝলাম না তোমারটাই, আজও...কষ্ট দাও বলে আর যন্ত্রণা পাইনা বিশ্বাস কর...শুধু জানিনা কেন দাও...রোজ আসবেই যদি তবে চলে গেলে কেন? মনে করবেই যদি তবে পাশে থাকা বন্ধ করে দিলে কেন? কেবল স্মৃতি নিয়েই থাকব? কেন চলে গিয়েও মুক্তি দিলে না?..."

"ভাই...তোকে ছেড়ে আমিই কী ভালো আছি?"

"তাই আমাকেও খারাপ রাখতে প্রতিদিন আসবে?" কান্না আর ক্রোধ মিখে যাচ্ছে প্রতিমুহুর্তে।

"না রে...তোকে কত ভালোবাসি তা কী বুঝিস?...তোকে না দেখে..."

"বাজে বকবে না...যেতে কে বলেছিল? আর এখন অকারণে আমাদের, আমাকে রোজ রোজ কষ্ট দিতে আস..."

"তোকে দেখতে, তোর সাথে কথা বলতে আমার আবার কারণ লাগবে নাকি রে?...হা হা এমনি আসি না রে..."

" কী ভাব তুমি? পারবে না, আর একদম পারবেনা...আমি ছোট ভাই বলে তোমার সব কিছু সহ্য করব নাকী?...রোজ আসবে আর রোজ চলে যাবে...ভাব রোজ রোজ চলে যাওয়ায় রোজ রোজ কষ্ট পাই?...তাহলে ভুল ভাব... কী ভেবেছ...মৃত্যুদিনের চেয়েও বেশী কষ্ট দিতে পারবে? বেশী কাঁদাতে পারবে? মনে করিয়ে দুঃখ দেবে? জেনে রেখ দুঃখ কে আর ভয় পাই না...যে দুঃখ তুমি চলে গিয়ে দিয়েছ তার কাছে এসব শিশু...একবার জিতেছ দাদা, ছোট ছিলাম জাপটে ধরে রাখতে পারিনি...ফাঁকি সেদিন দিয়েছ, আর পারবে না...রোজ আসবে তো? এসো, রোজ কথা বলব...কিন্তু আর কাঁদব না"...বলেই চলেছি প্রলাপের মত...হাজার হাজার জমে থাকা কথা যেন নিমেষে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে আসতে চাইছে...

 

চাঁদের আলো বেশ গাঢ় এইবার...ঝুম মারা আকৃতিটা উঠে দাঁড়ায়...মাথায় আবার আলতো করে হাত রাখে... "কাল আবার আসব...আজ কারণটা বুঝলি তো?"

 

বুঝেছি...বুঝেও আজ আটকাতে পারলাম কই?...

No comments:

Post a Comment